মিহির স্যার

ফিরে দেখা ২০২৩: অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি

ড: মিহির কুমার রায়: বিদায় ২০২৩ ও স্বাগতম ২০২৪ খৃষ্ঠাব্দ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত তৃতীয় মেয়াদের সরকারের শেষ বছর এবং আগামী ৭ই জানুয়ারিতে দেশের দ্বাদশ সাধারন নির্বাচন হওয়ার প্রস্তুতি চলছে  যেখানে দেশের প্রায় ৩৩টিরও বেশী রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে আজ বাংলাদেশ বিজয়ের ৫২তম বছর  পেরিয়ে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক দরবারে। সরকারের অর্থনৈতিক অর্জনসমূহকে জনগণের সেবার দ্বার গোড়ায়  পৌঁছাতে নিরলস চেষ্ঠা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তোরণ ঘটেছে, যুদ্ধ  বিধ্বস্থ দেশ থেকে আজকের এই উত্তোরণ যেখানে রয়েছে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়ার ইতিহাস, সরকারের রূপকল্প ২০২১  বাস্তবায়নে এটি একটি বড় অর্জন। আমাদের এটি সম্ভব হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাহসী এবং অগ্রগতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহনের ফলে যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কাঠামোগত রূপান্তর ও  উল্লেখযোগ্য সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে দ্রুত উন্নয়নের পথে নিয়ে এসেছে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ  স্মার্ট দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারনপূর্বক সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে।

তারপরও কেমন গেলো দেশের অর্থনীতি- এ প্রশ্নটি বারবারই আসে। সার্বিক মূল্যায়নে  দেখা যায়, বৈশ্বীক পরিস্থিতি   (রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ঠ) বিশ্বব্যাপী পণ্য ও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি, বাংলাদেশেও জ্বালানি তেল, নিত্যপণ্যে তথা  সেবা দাম বাড়াতে প্রভাব এবং বছরজুড়ে মূল্যস্ফীতি বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করেছে সত্যি, তবে যে কোনো মূল্যে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্ঠা চলছে সরকারি যন্ত্রের মাধ্যমে যেখানে মূদ্রানীতি একটি বড় নিয়ামক হয়ে দাড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতি ৮  শতাংশে নামিয়ে আনতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য নীতি সুদহার বা রেপো রেট একবারে দশমিক ৭৫  শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন নীতি সুদহার ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ফলে নতুন নীতি সুদহার বা রেপো  রেট হবে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো যে টাকা ধার করে, তার সুদহার বাড়বে।  পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতে রাখা আমানত ও ব্যাংক ঋণের সুদহারও বাড়বে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক আরও সংকোচনমূলক মুদ্রা  সরবরাহের পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিল। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য এত দিন মূলত: ডলারের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 
সুদের হার বাড়লে মানুষ সাধারণত ব্যাংকে আমানত রাখতে উৎসাহিত হন। দেশে গত সেপ্টেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে  ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশে নেমেছিল, যা আগস্টে ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। তবে সেপ্টেম্বর মাসে গ্রাম-শহর নির্বিশেষে খাদ্য  মূল্যস্ফীতি  ১২ শতাংশের ওপরেই ছিল। গত আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে ওঠে। বাংলাদেশ  ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে সত্যি কিন্তু এসব ব্যবস্থা কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।  কারণ যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, তা আংশিক ব্যবস্থা, পূর্ণাঙ্গ নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার দুই দফায় দশমিক ৭৫  শতাংশ বাড়িয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যাংক ঋণের ‘আপার ক্যাপ’ প্রত্যাহার করা হয়নি।

বাংলাদেশের মোট বাজেটের আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার মনে করছে, কর ও কর বহির্ভূত উৎস থেকে আয় করতে পারবে ৫ লাখ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে ঘাটতি থাকছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫  কোটি টাকা চলতি বছর সরকার পরিকল্পনা করেছে, তার মোট ঘাটতির মধ্যে ১ লাখ ৫৫৯ হাজার ২৯৫  কোটি টাকা পূরণ করবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আর দ্বিতীয় উৎসটি হলো বিদেশি ঋণ। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী চলতি বছর বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। দায়বদ্ধতার দিক থেকে  দুটি উৎস থেকেই অর্থ আহরণ ঋণ হিসাবে বিবেচিত, কিন্তু পরিশোধের বেলায় কিছুটা পার্থক্য আছে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে  প্রাপ্ত ঋণ সরকার স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধ করতে পারে, কিন্তু বিদেশি ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে  তা আন্তর্জাতিক মুদ্রায় এবং প্রধানত ডলারে পরিশোধ করতে হবে? প্রধানত দুটি উৎস থেকে রিজার্ভে ডলারের জোগান হয়। একটি হলো রপ্তানি আয়, অন্যটি বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স। গড়পড়তা হিসাবে বছরে ৫০  বিলিয়ন ডলার আয় হয় এবং রেমিট্যান্স আসে প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার। গত আড়াই বছরে ২৩ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৮  বাংলাদেশি নতুন করে বিদেশের শ্রমবাজারে যুক্ত হয়েছেন। বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএসইটি) তথ্য  বলছে, শুধু চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে (জানুয়ারি-জুন) ৬ লাখ ১৭ হাজার ৫৭৬ বাংলাদেশি অভিবাসী হিসাবে  বিদেশের শ্রমবাজারে যুক্ত হয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম ২ মাসে অর্থাৎ জুলাই-আগস্টে দেশে  রেমিট্যান্স এসেছে ৩৫৭ কোটি ২৬ লাখ ডলার। অথচ গত অর্থবছরের এ সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ৪১৩ কোটি ৩২ লাখ ডলার। বিদেশের শ্রমবাজারে যুক্ত হওয়ার প্রবাহ বাড়ছে, অথচ রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন,  হুন্ডির বাজার এখন যে কোনো সময়ের চেয়ে অধিকতর কার্যকর ও শক্তিশালী। ব্যাংক খাতে ডলারের দামের সঙ্গে  খুচরা বাজারে ডলারের দামের পার্থক্য ও হুন্ডির বাজার চাঙা হওয়ার আরেকটি কারণ। বর্তমানে ব্যাংক খাতে ডলারের বিনিময় হার ১১০ টাকা। কিন্তু খুচরা বাজারে ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ১১৭-১১৮ টাকা। এ বিরাট  পার্থক্যের কারণে বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীরা টাকা পাঠাতে আগ্রহী নন। আমাদের ম্যাক্রো অর্থনীতির স্থিতিশীলতার স্বার্থে  বিকল্প উপায় হলেও প্রবাসী আয় কী করে বাড়ানো যায় সেদিকে নীতি মনোযোগ দিতেই হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া  তথ্য বলছে ২০২৩ সালের ১-১৭ আগস্ট পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক প্রবাসী আয় এসেছে ১,০৪১ মিলিয়ন ডলার। গত বছরে এই  সময়ে তা এসেছিল ১,২৬১ মিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধির হার মাইনাস ১৭.৫%। আরও পেছনে ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ১৭  আগস্ট পর্যন্ত প্রবাসী আয় এসেছে ৩,০১৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালের ওই সময়ে তা এসেছে ৩,৩৫৭ মিলিয়ন ডলার।  প্রবৃদ্ধি মাইনাস ১০.২%।

কর আহরণের প্রবৃদ্ধি কমতির দিকে হলেও বাড়ছে সরকারি ঋণের পরিমাণ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে,  ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকারের ঋণ-জিডিপির অনুপাত ছিল ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ। পরের বছর, অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে  এ অনুপাত বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ দশমিক ৬ শতাংশে। ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারের ঋণ-জিডিপির অনুপাত বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ দশমিক ১ শতাংশে, আর বিদায়ি ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা সর্বোচ্চ হয়ে দাঁড়ায় ৪২ দশমিক ১ শতাংশে। ঋণ-জিডিপি অনুপাত  বেশি হওয়াটা শঙ্কার কারণ না হলেও, যদি ঋণের ব্যবহার উৎপাদনশীল খাতে না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এ ঋণ অসহনীয়  বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে; কিন্তু একটি বিষয় আমাদের কাছে এখনো পরিষ্কার নয়। সরকারি তথ্য বলছে, আমাদের প্রবৃদ্ধি  বেড়েই চলেছে। তাহলে করের অনুপাত বাড়ছেনা কেন? কিংবা সেই প্রবৃদ্ধির অংশ সাধারণ মানুষের মধ্যে বণ্টিত হচ্ছেনা  কেন? যে উন্নয়ন ধনীকে অধিকতর ধনী করে, গরিবকে করে আরও গরিব, সে উন্নয়ন সাধারণ মানুষের কাম্য কি? বিদেশি  ঋণ পরিশোধের চাপ দিন দিন বেড়ে চলেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) প্রতিবেদন অনুযায়ী,  ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছিল ২৭৪ কোটি ডলার। আগামী দিনের কথা যদি বিবেচনায় নিই,  তাহলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে  মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়াবে ৭ হাজার ৬৪৫ কোটি ডলার, যার মধ্যে  পরিশোধযোগ্য ৩২৮  কোটি ডলার। একইভাবে প্রাক্কলন করা হয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়াবে ৮ হাজার ৫২৪  কোটি ডলার এবং কিস্তি হিসাবে পরিশোধ করতে হবে ৪০২ কোটি ডলার।

অর্থনৈতিক অবস্থার একটি গুরুত্ব নিয়ামক হলো দেশের আমদানি-রপ্তানি। বাংলাদেশের মোট আমদানির ২৬ শতাংশ আসে চীন  থেকে। গত অক্টোবরে ৭১১ কোটি ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি হয়েছে যা গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে ৬২.৫০  শতাংশ বেশি। এর আগে সেপ্টেম্বরে ৬৯৯ কোটি ৬০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি হয়, আগস্টে আমদানি হয়েছিল ৬৫৮ কোটি  ৩৩ লাখ ডলারের পণ্য। গত জুলাই-অক্টোবর সময়ে মোট দুই হাজার ৫৮৩ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। এদিকে  জুলাই থেকে নভেম্বরে রপ্তানি বাণিজ্য থেকে ১ হাজার ৯৭৯ কোটি ডলার আয় হয়েছে। এ সময় রপ্তানি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে  ২৪.২৯ শতাংশ যা গত বছর একই সময়ে রপ্তানি আয় হয় ১ হাজার ৫৯২ ডলার। বছরের শেষ দিকে দেশের  অর্থনীতি সচল রাখা গেলেও উৎপাদন, ভোগ, আমদানি-রপ্তানি, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ব্যাংক ও আর্থিক খাত,  প্রকল্প বাস্তবায়ন, সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও মুদ্রাস্ফীতির মতো সূচকে যে প্রত্যাশা ছিল, তার চেয়ে অর্জনে স্থবিরতা ছিল। কারন নির্বাচনী বছর বাজেটে নানারকম জনপ্রত্যাশা থাকে এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার রয়েছে যার মধ্যে  রয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত পূরণের চাপ, সঙ্গে যোগ হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ,  আর্থিক খাতের সংস্কার, বাড়তি ৬৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়, বিদ্যুতে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদান,  ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে দেড় লক্ষাধিক টাকা ঋণ নেওয়ার বিষয় এবং একই সঙ্গে বিপুল অঙ্কের  সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন। তবে সরকার আশাবাদী, যত প্রতিকুলতাই আসুক সব কিছু জয় করতে সরকার বদ্ধ  পরিকর।

দেশে সবচেয়ে বড় বিপ্লব ঘটেছে কৃষি অর্থনীতিতে। বেশ কিছু তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৯৭২ সালে এ দেশে খাদ্যশস্যের মোট উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন বর্তমানে উৎপাদন বেড়ে তা হয়েছে ৪ কোটি ৬৬ লাখ ৮৭ হাজার  মেট্রিক টন উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৪ কোটি ৬৬ লাখ ৮৭ হাজার মেট্রিক টন। দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতার পর আজ দেশের মানুষ বেড়ে আড়াই গুণ হয়েছে। খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে চার গুণেরও বেশি। যদিও ১৯৭১-৭২ সালে মাথাপিছু জমির পরিমাণ ছিল ২৮ শতাংশ; এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১০ শতাংশ আর এভাবেই প্রধান খাদ্য-শস্যের উৎপাদন বাড়ানোর  ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) প্রকাশিত  এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের ২২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বিশ্বের সেরা দশে জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আজ ইলিশ এবং মৌসুমি ফলের মধ্যে কাঁঠাল উৎপাদনে প্রথম, পাট, সুপারি ও শুকনা মরিচ উৎপাদনে দ্বিতীয়,  চাল এবং রসুন উৎপাদনে তৃতীয়, মাছ এবং জামের মতো ফল ও সুগন্ধি মসলা উৎপাদনে চতুর্থ, মসুর ডাল ও  গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফল উৎপাদনে ষষ্ঠ, পেঁয়াজ, আলু, আদা, বেগুন, শিমের বিচি ও নারকেলের ছোবড়া উৎপাদনে সপ্তম, চা ও  কুমড়া উৎপাদনে অষ্টম, আম ও পেয়ারা, ফুলকপি ও ব্রকলি, মটরশুঁটি এবং পাখির খাদ্য উৎপাদনে নবম। ছাগল উৎপাদনে  বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ আর ছাগলের মাংস উৎপাদনে পঞ্চম। বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল বিশ্বের সেরা  জাত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আয়তনের দিক দিয়ে বিশ্বের ৯৪তম দেশ হলেও এফএওর হিসাবে দেখা যায়, প্রাথমিক কৃষিপণ্য  শুধু ফসল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৪তম। আয়তনের দিক দিয়ে বিশ্বের ৯৪তম দেশ হলেও এফএওর হিসাবে  দেখা যায়, প্রাথমিক কৃষিপণ্য শুধু ফসল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৪তম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার  (এফএও) ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার-২০২২’ বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,  স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয় স্থান ধরে রেখেছে। আর চাষের মাছে বাংলাদেশ দুই ধাপ এগিয়ে তৃতীয় অবস্থানে  উঠে এসেছে। কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে প্রকৃতি ও জনসংখ্যার সঙ্গে সমন্বয় রাখতে যুদ্ধ  করে এগিয়ে চলেছে। সময়ের বিবর্তনে এসেছে নতুন নতুন ফসল, প্রসারিত হচ্ছে নব নব প্রযুক্তি। কৃষিকে বহুমুখীকরণে বাংলাদেশ এখন বেশ অগ্রগামী। কৃষি সেক্টরে ধান, পাটের পাশাপাশি মৎস্য ও পশুপালন, দুগ্ধ উৎপাদন, হাঁস-মুরগি পালন,  নার্সারি, বনায়ন এবং কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্র শিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটছে বাংলাদেশে।

বিগত ২৮শে ডিসেম্বর, ২০২২, ঢাকা মেট্রোরেল (উত্তরা থেকে আগারগাওঁ) চালু যা যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি বিশ্বয়কর ঘটনা। শিক্ষা খাতে শতভাগ ছাত্রছাত্রীর মাঝে বিনামূল্যে বই বিতরণ, নারী শিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে প্রাথমিক থেকে  মাধ্যমিক পর্যন্ত উপবৃত্তি প্রদান বর্তমান সরকারের অগ্রগতির অন্যতম নিয়ামক। এছাড়াও ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক  বিদ্যালয় জাতীয়করণ ও শিশু শিক্ষার্থীর হার ৯৭.৭ ভাগে ঊন্নিতকরণ। এছাড়াও শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট আইন ২০১২ প্রনয়ন ও  গঠন করা হয়েছে শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট। অতি সম্প্রতি সরকার ৩৭ হাজার ৫৭৪ জন কে সরকারী প্রাইমারী  স্কুলের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দিয়েছে। আবার স্বাস্থ্য খাতের সবচেয়ে বড় অর্জন টিকা খাতে, শিশুদের ও চলমান করোনার টিকা দান কর্মসূচীতে বিশ্বের মধ্যে অন্যতম আদর্শ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে কমিউনিটি ক্লিনিক,  উপজেলায় ৫০ শয্যার হাসপাতাল ও জেলা পর্যায়ে মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের মাধ্যমে বড় ধরনের অগ্রগতি সাধন করেছে।  স্বাস্থ্য সেবাকে মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছানোর লক্ষ্যে ১২ মেডিক্যাল স্থাপন ও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৪৭ হাজারের ও বেশী দক্ষ  জনবল অর্থাৎ নার্স ও ডাক্তার। তথ্য প্রযুক্তিতে  ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন স্মার্ট বাংলাদেশে রুপ নিচ্ছে যা সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

তবে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে বাংলাদেশকে যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, এলডিসি হিসেবে পাওয়া শুল্কমুক্ত ও বিভিন্ন অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা থাকবেনা। এর ফলে রপ্তানি বিশেষত: তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। অন্যদিকে কৃষিতে ভর্তুকি সুবিধা সীমিত করতে হবে। এসব চ্যালেঞ্জ  মোকাবিলায় এর মধ্যে প্রস্তুতিও শুরু করেছে সরকার। তারপরও যে বিষয়গুলো সারা বছরব্যাপি আলোচনার শীর্ষে ছিল তা হলো মূল্যস্ফীতির অভিঘাত, অব্যাহতভাবে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য হ্রাস, জীবন যাত্রার মূল্য বৃদ্ধি, রিজার্ভের ক্রমাগত অবণতি, আর্থিক ব্যবস্থাপনায় তারল্য সংকট, ব্যাংক ব্যবস্থাপনার প্রতি আস্থার সঙ্কট, প্রধান খাদ্য চালের উচ্চমূল্য, বাজার সিন্ডিকেটের প্রাধান্যতা, সামাজিক/অর্থনৈতিক জীবনে বৈষম্য বৃদ্ধি, অর্থ পাচার, খেলাপী ঋণের দৌরাত্ব ও রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থনীতিকে চাপের মধ্যে রেখেছিল। তারপরও ভিশন-২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ  বিনির্মাণে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনা খ্যাত‘ডেল্টা প্ল্যান-২১০০’ বাস্তবায়নের কাজ পূর্ণ উদ্যমে  এগিয়ে চলছে। মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়াতে দ্রুত এর কাজ এগিয়ে নেয়া এবং ঝুঁকি হ্রাসে বিভিন্ন বিভাগ ও  মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এর সমন্বয় করা প্রয়োজন। এ মহাপরিকল্পনার প্রথম ধাপের কাজ ২০৩০ সালের মধ্যে শেষ করা হবে।  আগামী ২০ থেকে ২৫ বছরে দেশের অর্থনীতি সার্বিকভাবে সম্প্রসারিত হবে। আগামী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের  অর্থনীতি মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডের মতো হয়ে যাবে। এ সুযোগকে এগিয়ে নিতে পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনার পাশাপাশি ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন করা হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, সেটা  দেশের অর্থনীতি এবং দেশের মানুষের আর্থিক ক্ষমতা বদলে দেবে। ২০২৩ সাল বর্তমান সরকারের শেষ বছর এবং উন্নয়নের জন্য সরকারের ধারাবাহিকতার কোন বিকল্প নেই। আসুন দলমত নির্বিশেষে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী প্রজন্মের জন্য  একটি উন্নত সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়ে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে কাজ করি। 

লেখক: অধ্যাপক ও গবেষক।

বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই/এসএএম//


Comment As:

Comment (0)