মিহির

স্মার্ট বাংলাদেশ: নতুন সরকারের অঙ্গীকার

ড: মিহির কুমার রায়: ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গত ২৭  ডিসেম্বর হোটেল সোনারগাঁওয়ে আওয়ামী লীগের ইশতেহার ঘোষণা করেন দলের সভাপতি বঙ্গবন্ধু কন্যা   দেশরত্ন শেখ হাসিনা। এবারের সংসদ নির্বাচনে ইশতেহারের স্লোগান  দেওয়া হয়েছে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ: উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান”। ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারের স্লোগান ছিল ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ: দিনবদলের সনদ, ২০১৪ সালে স্লোগান ছিল ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’, ২০১৮ সালে স্লোগান ছিল ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’, আর এবারও বিগত ইশতেহার  গুলোর ধারাবাহিকতায় লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লক্ষ্যে স্মার্ট  বাংলাদেশ অর্থাৎ ‘স্মার্ট নাগরিক’, ‘স্মার্ট সরকার’, ‘স্মার্ট অর্থনীতি’ ও ‘স্মার্ট সমাজ’ গড়ার কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়েছে।  ইশতেহারে সুনির্দিষ্ট ১১টি বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, যেমন - মূল্যস্ফীতি, কর্মসংন্থান, ব্যাংক সহ আর্থিক খাতে দক্ষতা, আধুনিক  প্রযুক্তি নির্ভরতা, কৃষি ব্যবস্থা যান্ত্রিকীকরণ, সর্বজনীন পেনশন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষা ইত্যাদি।

বিগত ৭ই জানুয়ারী উৎসবমুখর পরিবেশে সারাদেশে ২৯৯টি আসনে ভোট গ্রহন সম্পন্ন হয়েছে যেখানে ২৮টি রাজনৈতিক দলের ১৯৬৯ জন প্রার্থী অংশগ্রহন করেছিল এবং এরি মধ্যে ফলাফলও বেসরকারীভাবে ঘোষনা করা হয়েছে যেখানে দেখা যায় যে আ. লীগ ২২২ টিতে, জা. প্রার্থী ১১টিতে, স্বতন্ত্র ৬২টিতে এবং অন্যান্য ৩টিতে বিজয়ী হয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলছে শান্তিপূর্ণভাবে অবাধ/নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনের দিন সন্ধ্যায় হোটেল সোণারগাঁয়ে অনুষ্ঠিত ব্রিফিংএ বিদেশী পর্যবেক্ষক দলও নিরপেক্ষ অংশগ্রহনমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে মত প্রকাশ করেছে এবং আন্তর্জ্যতিক মিডিয়াতেও বাংলাদেশের নির্বাচন বিশেষ কভারেজ পেয়েছে যা দেশের গনতন্ত্রের জন্য  সুফল বার্ত। এর মধ্য দিয়ে সরকারের ক্ষমতার নবায়ন ঘটল। নানা চ্যালেঞ্জের মুখেও সারাদেশে দ্বাদশ সংসদ  নির্বাচনে ভোট সুষ্ঠু হয়েছে যদিও বিরোধী বলয় নির্বাচনের দিন হরতাল দিয়েছিল যার কোন প্রভাব দেখা যায়নি সারাদেশে। এখানে উল্লেখ্য যে  সারাদেশে ৪২ হাজার ২৪টি কেন্দ্রে  দুই লক্ষাধিক বুথে  নির্বাচন হয়েছে যা একটি বড় আয়োজনও বটে। সব মিলিয়ে নির্বাচন কমিশন বলেছে–  ৪১.৮ শতাংশের মতো ভোট পড়েছে যাকে খুব ভালো উপস্থিতি বলা যায়। কারণ আমরা জানি, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। সে নির্বাচনে ৫৫ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছিল। তখনতো পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ ছিল। তখন যদি ৫৫ শতাংশ  হয়, আর এখন ৪১ শতাংশ হওয়া মানে – যথেষ্ট। আমরা এমনকি নাগরিক হিসেবে বার বার বলেছি, সবার অংশগ্রহণে একটা নির্বাচন চাই,  সরকার সংবিধানের পথে অবিচল ছিল, সে অনুযায়ী ভোট করেছে এবং একে আমরা নির্বাচন সফল হয়েছে বলব। উল্লেখ্য,  নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে ৩৫টি দেশের পর্যবক্ষকেরা ঢাকায় এসেছিলেন।

নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা ৯ই জানুয়ারী মহান জাতীয় সংসদ ভবনে শপথ গ্রহন করেন এবং ১১ই জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে  নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে টানা চতুর্থ মেয়াদে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন সরকার নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে গঠিত হয় এবং নতুন মন্ত্রিসভায়  ২৫ জন মন্ত্রী ও ১১ জন প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা চতুর্থ মেয়াদের মন্ত্রিসভায় বেশ কিছু নতুন মুখ এসেছে। এ  ছাড়া বিদায়ী মন্ত্রিসভার অধিকাংশ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী নতুন মন্ত্রি সভায় স্থান পাননি। পাশাপাশি পদোন্নতি পেয়ে নতুন মন্ত্রি সভায় পূর্ণ মন্ত্রী  হচ্ছেন বর্তমান জন প্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। নতুন মুখ যারা মন্ত্রি সভায় অন্তর্ভুক্ত  হয়েছেন তাদের মধ্যে উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, আব্দুর রহমান, সাবের হোসেন চৌধুরী, সামন্ত লাল সেন, মোহাম্মদ আলী আরাফাত ও  সিমিন হোসেন রিমি অন্যতম।

নির্বাচনের পরদিন ৮ই জানুয়ারি বিকেল সাড়ে ৩ টায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী  শেখ হাসিনা গণ ভবনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন-২০২৪ উপলক্ষে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করেন।  ভারতীয় সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষক প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছিলেন স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে স্মার্ট কেবিনেট প্রয়োজন এবং এই বিষয়টি আগে থেকেই  প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনায় ছিল বিধায় নতুন কেবিনেটে অর্ধেকেরও বেশী নতুনদেরকে দেখা যায় যারা স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করবে। এখন প্রশ্ন হলো বিগত বছরটি অর্থনীতির দুটি বিষয় বিশেষত: মূল্যস্ফীতি ও আর্থিক খাত যে ভাবে আলোচনায় এসেছে  সেগুলো উত্তরাধিকার সূত্রে নতুন সরকারকে আরও জোড়ালোভাবে মোকাবেলা করতে হবে বিধায় অর্থ ও বানিজ্য মন্ত্রনালয়ে নতুন নেতৃত্ব  সৃষ্ঠি করা হয়েছে। এখন দেখার বিষয় এদুটি খাতে পরিবর্তন এত সহজ হবে বলে মনে হয় না যা আওয়ামী লীগের ইশতেহারে সর্বাগ্রে রয়েছে। যেমন ডলার-সংকটের মধ্য দিয়েই গত বছরের শুরুটা হয়েছিল এবং বছরটা শেষ হয়ে এলেও পরিস্থিতির  তেমন উন্নতি হয়নি কিংবা সংকট কাটেনি যা বর্তমান বছরেও রয়েছে। ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম গত বছরের শুরুতে ছিল ১০৩ টাকা, যা বেড়ে এখন হয়েছে ১১০ টাকা।  নতুন বছরে পুরো ব্যাংক নিয়মের মধ্যে না ফিরলে বড় ঝুঁকি দেখছেন খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। গত ২০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী  (বিপিএম৬) দেশের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। ২৭ ডিসেম্বর রিজার্ভ বেড়ে ২১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়।  উচ্চ সুদে সরকারের ঋণ যা দ্রব্যমূল্যের উচ্চ দাম ও টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়ার কারণে সারা বছরই মূল্যস্ফীতি ছিল বাড়তি। একটি  দেশের অর্থনীতির মাপকাঠি হলো ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ, বিনিয়োগ, জিডিপির গ্রোথ রেট, প্রাইস লেভেল মুভমেন্ট এবং এক্সচেঞ্জ রেট। দেশের  অর্থনীতির এ কয়েকটা বিষয় গত এক বছর থেকে দেশের অনুকুলে নয় যা নতুন সরকারকে মোকাবেলা করতে হবে। আস্থার সংকটে নিয়ে  ভোগছে দেশের ব্যাংকিং খাত। ব্যাংকে টাকা রেখে ঠকছেন আমানতকারীরা, ব্যাংক যে হারে সুদ দিচ্ছে, তার তুলনায় মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি,  এতে প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে এবং এখন ব্যাংকে অর্থ রাখা মানেই লোকসান। এমনিতেই ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা কম এবং এ  অবস্থায় আমানত রেখে ঠকলে মানুষের মধ্যে সঞ্চয়ের প্রবণতা আরও কমে যাবে। ব্যাংক খাতে সুশাসন ও রাজস্ব আয় বাড়ানোর দৃষ্টিকোণ থেকে  নতুন আয়কর আইন পাস করার পাশাপাশি ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের বাস্তবায়ন দেখতে হবে; ডলারের দাম খোলা বাজারের সঙ্গে  সমন্বয় করতে হবে; ব্যাংক খাতে অব্যবস্থাপনা-অনিয়ম, খেলাপি ঋণ, কিছু ব্যাংক দুর্বল হওয়ার কারনে তাদেরকে একিভূত করা যেতে পারে;  দেশে ধারাবাহিকভাবে দারিদ্র্যের হার কমলেও বেড়েছে আয় বৈষম্য। সেই সঙ্গে গ্রামে বেড়েছে মানুষের খরচ। পাশাপাশি বেড়ে গেছে পরিবারভিত্তিক ঋণ গ্রহণও। এছাড়া শহরের চেয়ে গ্রামে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতাও বেশি। মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। 

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রনে আনার জন্য মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি এবং সামাজিক সুরক্ষা নীতি-তিনটাকে একসঙ্গে সমন্বয় করে কাজে লাগাতে হবে। প্রয়োজনে আমদানি শুল্ক কমাতে হবে, যাতে পণ্য আমদানি ব্যয় কমে। এখনো অনিয়ন্ত্রিত ডলারের মূল্য। এ জন্য বিনিময় হার একটি বান্ডেলের মধ্যে আনতে হবে। সুদের হারের মতো বিনিময় হারও একটি স্থিতিশীল ব্যবস্থার মধ্যে আনতে হবে; যাতে ভবিষ্যতে  বিনিময় হারে অস্থিরতা কমে আসে। প্রতি বছরে বিপুল সংখ্যক মানুষ বিদেশে গেলেও সে হারে আয় দেশে আসছে না।  দুটি কারণে প্রবাসী আয় আনা যাচ্ছে না। তাহলো দক্ষ শ্রমিক পাঠানো যাচ্ছে না। এ ছাড়া প্রবাসী আয়ের ডলারের মূল্য ও প্রণোদনা বাড়াতে হবে। প্রবাসীরা বিমান বন্দরে যেন অযথা হয়রানির শিকার না হন, সে ব্যবস্থা করতে হবে। হুন্ডির বাজার বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা  গ্রহন করতে হবে। দেশের ব্যয়ের ক্ষেত্রে আয়ের সঙ্গে সংগতি রাখতে হবে। গত বছরের শেষের দিকে রপ্তানি কমেছে।  রপ্তানি আয় বাড়াতে পুরোনো বাজার ধরে রাখার পাশাপাশি নতুন বাজারে মনোযোগ দিতে হবে। পণ্যের বহুমুখীকরণের দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থা এমন হতে হবে, যেন লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থান হয়। প্রয়োজনে উদ্যোক্তাদের সঙ্গে করে কারিকুলাম  তৈরি করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নূতন বছরে এই ইস্যুগুলো নূতন সরকারকে মোকাবেলা করতে হবে।
 
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সমাজে বৈষম্য বাড়ছে, রাজনৈতিক অস্থিরতাও চলমান। এসবের আলোকে আগামীদিনে কীভাবে আমরা এ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার যে মৌলিক উপাদানগুলো আছে, সে উপাদানগুলোকে রক্ষা করব বা সুরক্ষা দেব, সেটাও এখনো অজানা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইতোমধ্যেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কিন্তু অভিনন্দন জানালেও আমার কাছে পশ্চিমা বিশ্ব কিংবা গণতান্ত্রিক বিশ্ব এ নির্বাচনটা নিয়ে বেশ কঠিন প্রশ্ন তোলা শুরু করেছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে থাকার ওপরই কিন্তু আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, উন্নয়ন কিংবা আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের ভাবমূর্তি ইত্যাদি নির্ভরশীল। তবে অনেক কিছুই নির্ভর করবে নতুন সরকার কীভাবে তার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিটাকে সাজানোর চেষ্টা করে তার ওপর। সেটার ওপরই আগামী ৫ বছর বাইরের বিশ্বের সঙ্গে আমাদের কী ধরনের সম্পর্ক হবে, তা অনেকাংশেই নির্ভর করবে। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সক্ষমতা রয়েছে দেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে। মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়, মাতৃভূমির স্বাধীনতা থেকে শুরু করে এদেশের যা কিছু মহৎ অর্জন, তা এসেছে আওয়ামী লীগের হাত ধরে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক বাহক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাত ধরেই ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠিত হবে।’ তাই আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনে করেন, কাজ করতে গিয়ে কিছুটা ভুল হতেই পারে যা বাংলার মানুষ ভালভাবেই নেবে।

লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ।

বিনিয়োগবার্তা/ডিএফই//


Comment As:

Comment (0)