বেকারত্ব দূর করতে নতুন উদ্যোক্তা তৈরির বিকল্প নেই

দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বিপুল। কিন্তু কেন? সেই ঔপনিবেশিক যুগে দেশে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের কাল থেকেই পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাত্রছাত্রীর মনে এই ধারণা ঢুকিয়ে দিয়ে আসছে যে পড়াশোনা করে জজ-ব্যারিস্টার হতে হবে। এখনকার পরিবার সন্তানদের আর জজ-ব্যারিস্টার হওয়ার কথা বলে না। কিন্তু পড়াশোনা করে ভালো চাকরি করতে হবে—এ কথাটা আমাদের সবার কানেই মন্ত্রের মতো ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। চাকরি ছাড়া অন্য কিছু করার কথা মধ্যবিত্ত সমাজ ভাবতেও পারে না। আমাদের এখানে বাস্তবতাই এমন।

কিন্তু এখন সময় এসেছে এ মানষিকতা থেকে বের হয়ে নতুন উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্ঠা করার। এর মাধ্যমে নিজে ভাল থাকতে হবে, অপর ১০ জনকেও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

তবে এটিও সত্য, একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হয়েও বাংলাদেশে একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের উচ্চশিক্ষিত সন্তানের পক্ষে উদ্যোক্তা হওয়া বড়ই কঠিন। আর এ কারনেই সবাই চাকরির পেছনে ছোটেন।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির তরুণদের চাকরি না খুঁজে উদ্যোক্তা হতে বলেছেন। তার পরামর্শ খুবই ভাল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষ উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী হবে না। ব্যাংকগুলোর কাছে ঋণের জন্য গেলে ওরা অনেক ডকুমেন্ট চায়, যা নতুনদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব হয় না। এমতাবস্থায় নতুন উদ্যোক্তা তৈরীতে ডকুমেন্টস দেওয়া বাধ্যবাধকতাকে আরও সহজ করতে হবে।

বড় ব্যবসায়ীরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছেন, দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ ভালো নয়। ফলে কাঙ্ক্ষিত হারে বিনিয়োগ বাড়ছে না। ব্যাংকে প্রচুর পরিমাণে টাকা অলস পড়ে আছে। এ নিয়ে প্রায়ই সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। কিন্তু কাজের কাজ তেমন একটা হয় না। বিনিয়োগ না হওয়ায় দেশে কর্মসংস্থানও বাড়ছে না। তবে গত কয়েক বছরে সরকারি চাকরিতে অনেক নিয়োগ হয়েছে। সরকার আর কত মানুষকে নিয়োগ দেবে। তার পক্ষে তো আর সবার কর্মসংস্থান করা সম্ভব নয়। সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধি ও পদ্মা সেতুসহ বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প চলমান থাকায় প্রবৃদ্ধির চাকা একভাবে সচল আছে। কিন্তু বিনিয়োগ না বাড়লে এটা টেকসই হবে না।

দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতেই সবচেয়ে বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তাই ক্ষুদ্র উদ্যোগের ওপরই আমাদের সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া উচিত। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা যদি বড় হন, তাহলে তাঁরা আরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান করতে পারবেন। এ লক্ষ্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকেও ঢেলে সাজানো দরকার। ঘরে ঘরে স্নাতক তৈরি না করে আমাদের উদ্যোক্তা তৈরিতে নজর দেওয়া উচিত। শিক্ষাব্যবস্থাকে সেভাবেই ঢেলে সাজানো উচিত।

একজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি চাকরি করে রাষ্ট্রকে হয়তো বছরে ২০/২৫ হাজার টাকা রাজস্ব দেবেন। কিন্তু তিনি যদি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হন, তাহলে অন্তত ১০ জন মানুষকে নিয়োগ দিতে পারবেন। এতে যেমন তাঁর জীবনের নিরাপত্তাহীনতা দূর হবে, তেমনি ওই ১০ জনও চাকরি পাবেন। প্রযুক্তি খাতে উদ্যোক্তা তৈরির অনেক সুযোগ আছে। বিশ্বায়নের বদৌলতে এখন ভারতসহ আমাদের মতো দেশগুলো আউটসোর্সিংয়ের বড় বাজার হয়ে উঠেছে। ভারত ইতিমধ্যে এ খাতে বড় অগ্রগতি অর্জন করেছে। আমরাও এই পথে হাঁটতে শুরু করেছি। ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। তবে এটা এখনো অল্প কিছু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এটাকে আরও ছড়িয়ে দেওয়া গেলে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান করা সম্ভব। একই সঙ্গে ইন্টারনেটভিত্তিক ই-কমার্স সেবাও দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অনেক তরুণ-তরুনী এতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

এই পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের উচিত হবে, নীতি সহযোগিতা দিয়ে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো।

প্রথমত, কোন কোন খাতে উদ্যোক্তা তৈরি করা সম্ভব, তার একটি বাস্তবসম্মত জরিপ করতে হবে। এর ভিত্তিতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে উদ্যোক্তা তৈরির কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। সারা দেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এরপর উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে হবে।

আশার কথা, সরকার ইতিমধ্যে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। আইটি ও কৃষি খাতের কিছু প্রতিষ্ঠানকে সুদবিহীন ঋণও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই টাকা নির্ধারিত সময়ের পর ফেরত আসেনি। অথচ অনেক প্রকৃত উদ্যোক্তা প্রয়োজনীয় তহবিলের অভাবে ব্যবসা এগিয়ে নিতে পারছেন না বলে জানা গেছে।

ইতিমধ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোক্তা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া শুরু হয়েছে। সময় এসেছে ব্যবসা শুরুর প্রক্রিয়া সহজতর করার। পাশাপাশি আমাদের মনোভাবেও পরিবর্তন আনতে হবে। চাকরিজীবী থেকে উদ্যোক্তা হওয়ার মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে পরিবর্তন আসবে না।

(বিনিয়োগবার্তা, ১৮ মার্চ ২০১৭)


Comment As:

Comment (0)