পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহের প্রক্রিয়া আরও সহজ করা উচিত: মাহমুদুর রহমান সুমন

মো: মাহমুদুর রহমান সুমন। দেশের উদীয়মান তরুন উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম। গ্রীস-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্বরত। দেশের অন্যতম শিল্পগোষ্ঠী জাহিন গ্রুপেরও পরিচালক হিসাবে দায়িত্বরত রয়েছেন তিনি। সম্প্রতি বিনিয়োগবার্তার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পায়ন ও পুঁজিবাজার নিয়ে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকারটির চুম্বক অংশ পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরা হলো।

বিনিয়োগবার্তা: সমসাময়িক ব্যবসায়িক পরিবেশ নিয়ে বলুন।

মাহমুদুর রহমান সুমন: ব্যবসায়িক পরিবেশের দিক থেকে সাম্প্রতিক সময়টা খুব ভালো যাচ্ছে বলে আমার কাছে মনে হয় না। কারণ, ২০১৭  সালে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের  তিন দফা মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। এখন আবার বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে।  অথচ গ্যাসের অবৈধ লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয়নি। এক্ষেএে যারা বৈধ  তারা অবৈধ লাইনের ভর্তুকি কেনো দিবে ।  এটা ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর একটা বাড়তি চাপ।  এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্যে দূর্বল হয়ে  পরবে।  রাস্তাঘাটসহ অনান্য অবকাঠামোর অবস্থাও খারাপ। রাস্তায় দু:সহনীয় যানযট। ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তায়

পার করে দিতে হয়। দেশের সবচেয়ে বড় বন্দর থেকে ঢাকায় পণ্য পৌঁছাতে ১২/১৪ ঘন্টা সময় লেগে যায়; এটা খুবই অস্বস্তিকর। এতে জ্বালানি ও সময়

দুটোই ব্যয় হয়। এছাড়াও রয়েছে চট্টগ্রাম র্পোটের লাল ফিতার দৌরাত্ন। নানা জটিলতায় এখান থেকে পণ্য রপ্তানি কিংবা খালাসে সময়ক্ষেপন হয়। গ্রাহক পর্যায়ে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। সরকার থেকে বিদ্যুতের পর্যাপ্ততা রয়েছে বলা হচ্ছে অথচ বিদ্যুতের লোডশেডিং প্রায় সব এলাকায়ই দেখা যাচ্ছে।  গ্যাসের স্বল্পতায় ৩০% উৎপাদন কমে গেছে ।  এসব পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেএে বড় ধরনের হুমকি ।

অন্যদিকে ব্যাংকগুলোতে আস্থাহীনতার বড় অভাব দেখা দিয়েছে।  অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে  ব্যাংক আর ব্যাংকারদের সাথে গ্রাহকের একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেছে।  সুদের হার নিয়ে বহু দিন ধরে বলাবলি হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কি হয়েছে তাতো সকলেরই জানা। এই যে ব্যাংক খাতে আস্থাহীনতা, অরাজকতা ও অব্যবস্থাপনা এ জন্য দায়ী কে? ব্যাংক ও গ্রাহক দুই পক্ষের  একটা আস্থাহীনতার  অভাব  রয়েছে; এটি দূর করতে হবে।

ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগবান্ধব হতে হবে।  প্রকৃত উদ্যোগক্তাদেরকে বা গ্রাহকদেরকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা করতে হবে। এসব বিষয়ের যথাযত সুরাহা না হলে দেশে শিল্প-কারখানায় বিনিয়োগ কমেবে। উৎপাদন ব্যহত হবে। অর্থনীতিতে যার বিরূপ প্রভাব পড়বে। তাই এসব বিষয়ে সতর্ক হওয়া উচিত।

বিনিয়োগবার্তা: শিল্পায়নের বিকল্প আর্থায়নের উৎস হিসেবে পুঁজিবাজারের সম্ভাবনা নিয়ে বলুন?

মাহমুদুর রহমান সুমন: পৃথিবীর উন্নত দেশে শিল্পোন্নয়নে বিকল্প অর্থায়নের উৎস হিসাবে পুঁজিবাজারকে বেছে নেওয়া হয়। আমাদের এখানে এখনো সে ধরনের কিছু হয়ে উঠেনি। অথচ এটিই হওয়া উচিত। ব্যাংক ও পুঁজিবাজার দুইয়ে মিলে সাপোর্ট দিলে দ্রুত শিল্পের উন্নয়ন ঘটবে। আমরা বিগত বছরগুলোতে শিল্পকারখানাগুলোকে র্পুঁজিবাজার থেকে কিছুটা সাপোর্ট পেতে দেখে আসছি।  বিনিয়োগের ক্ষেএে এতো স্থবিরতার মধ্যেও কিন্তু পুঁজিবাজার থেকে বড় ধরনের একটা মূলধন সংগ্রহ হচ্ছে।  এটা প্রবৃদ্ধির ক্ষেএে বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। বেকারত্ব কমছে-কর্মসংস্থান বাড়ছে। তবে এই প্রবণতা আরো বৃদ্ধি করা উচিত। সরকারের উচিত ব্যাংকিং চ্যানেলের পাশাপাশি পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহের দিকে কোম্পানিগুলোকে ধাবিত করা। তবে মূলধন সংগ্রহের প্রক্রিয়াটি আরও সহজ করা উচিত বলে আমার কাছে মনে হয়। আর এটি হলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেএে পুঁজিবাজার দারুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে।  এতে  শিল্পন্নোয়নও তরান্বিত হবে।

বিনিয়োগবার্তা: কালো টাকা বিনিয়োগ নিয়ে অনেকদিন ধরেই কথাবার্তা হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?

মাহমুদুর রহমান সুমন: অ-প্রর্দশিত আয় যদি প্রর্দশনের সুযোগ থাকে এবং অ-প্রর্দশিত আয় যদি একটা নির্দিষ্ট খরচ দিয়ে  যেমন-৩%-৫% ভর্তুকি দিয়ে বাজারে বৈধ ভাবে আনতে পারে তাহলে দেশের জন্য বিনিয়োগ বাড়বে।  আর যদি এই সুযোগটা সংশ্লিষ্টরা না পায় তাহলে টাকাটা দেশে ব্যবহার হবে না বা বিদেশে চলে যেতে পারে।  দেশে এই টাকা বিনিয়োগের যথেষ্ট জায়গা রয়েছে। এসবের মধ্যে পুঁজিবাজার, আবাসন খাত অন্যতম। পাশাপাশি শিল্পন্নোয়নেও এ টাকা ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে সবই হতে হবে একটি নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে থেকে। এসব টাকা এখানে বিনিরয়োগ হলে সার্বিক আর্থিক ফ্লো বাড়বে। দেশের মানুষ উপকৃত হবে। আরেকট বিষয় হচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগ নির্ভর করে কিন্তু দেশীয় বিনিয়োগের উপর। এক্ষেএে দেশীয় উদ্যোক্তারা যদি বিনিয়োগ করে তাহলে বিদেশীদের বিনিয়োগের আগ্রহ বাড়ে। তাই যে ব্যবস্থায়ই হোক কালো টাকা দেশে বিনিয়োগের ব্যভস্থা করা উচিত বলে আমি মনে করি।

বিনিয়োগবার্তা: বাংলাদেশের বস্ত্র খাতের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বলুন?

মাহমুদুর রহমান সুমন: বর্তমানে বাংলাদেশের কর্মপেযোগি ৮০ শতাংশ লেকবাল বস্ত্রখাতের উপর  নির্ভরশীল । বাংলাদেশ এখন বিপুল জনসংখ্যা নিয়ে এই খাতে কাজ করছে। দেশের প্রায় বিশ কোটি জনগনের বস্ত্র চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে হাজার কোটি টাকার বস্ত্র রপ্তানি করা হচ্ছে । দেশের মোট রেমিট্যান্স আয়ের বড় একটি অংশ আসছে বস্ত্র খাত থেকে। আশঙ্কার কথা হলো- গত কয়েক বছর আগেও বস্ত্র রপ্তানিতে আমরা ছিলাম ইউরোপ-আমেরিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে, কিন্তু বর্তমানে আমাদের পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে আর আমরা  নেমে এসছি পঞ্চম স্থানে।  এর পিছনে বড় কারন হলো  অনান্য রাষ্ট্রের তুলনায় বাংলাদেশে এ খাতে র্ভতুকির পরিমান খুবই কম। তাছাড়া বিদ্যু-গ্যাস যোগানের স্বল্পতাও রয়েছে। দেখুন,  ভারতের গুজরাটে গার্মেন্টস্ শিল্পের জন্য ২৫% র্ভতুকি দিচ্ছে সেদেশের সরকার । কিন্তু আমাদের সরকার এ খাতে বর্তমানে ৩%-৫% র্ভতুকি দিচ্ছে, যা তুলনামূলকভাবে খুবই সীমিত।  সর্বোপরি এই খাতের উন্নয়নের জন্য সরকারের প্রনোদনা ও বরাদ্দ বৃদ্ধিই জরুরী।

 

বিনিয়োগবার্তা: সরকার পরিবর্তন হলে ব্যবসায়িক পরিবেশ বা উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হয়। এ বিষয়ে আপনার পরামর্শ কি?

মাহমুদুর রহমান সুমন: আসলে গণতান্ত্রিক দেশে সরকার আসবে সরকার যাবে এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি নীতি বা উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ করা কোনোভাবেই উচিত নয়। পৃথিবীর উন্নত দেশে এমনটি হয় না। বিদেশে দেশের বা উন্নয়নের প্রশ্নে সব সরকারই এক নীতিতে চলে। আমাদের এখানেও এমনই হওয়া উচিত। দেশকে বা দেশের উন্নয়নকে সবার ওপরে স্থান দেওয়া উচিত। কারণ দেশ উন্নত হলে দীর্ঘমেয়াদে সকলেই এর সুফল পায় কোনো একক সরকার নয়। তাই এ বিষয়ে সব দল-মতেরই একাট্টা হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।

(জেভি/এসএএম/ ২৬ মে ২০১৮)

 

 


Comment As:

Comment (0)